কোষের ভেতরে, কোয়ান্টাম কণাতে



   বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সম্মানজনক পুরস্কারগুলোর একটি নোবেল পুরস্কার। সুইডিশ বিজ্ঞানীআলফ্রেড নোবেলের নামানুসারে এই পুরস্কার ছয়টি বিভাগে প্রদান করা হয়। প্রতিবছরবিজ্ঞানের তিনটি বিভাগে বিভিন্ন গবেষণার জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়।২০১২ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন আর তাঁদের কথা নিয়ে এবারের মূল রচনা। 

রসায়ন: জি প্রোটিনের মতিগতি পিঁপড়ার কামড়ে আমাদের হাত-পা ফুলে ওঠে বা কখনো কখনো মৌমাছি ও বোলতার শূলের আক্রমণে আমরা লাল হয়ে উঠি। দেহের বাইরের এ রকম বিভিন্ন উদ্দীপনা ও অনুভূতির তথ্য আমাদের মানবদেহের কোষ থেকে কোষান্তরে ছড়িয়ে যায় নিমেষেই। আমাদের মাথায় যখন এরকম তথ্য পৌঁছে যায়, তখনই আমাদের ঘাড়ের রক্ত খেয়ে ফুলে ওঠা নাদুসনুদুস মশাকে থাপড় দিই। এই শারীরিক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের জন্য কোষের পর্দা বা কোষঝিল্লিতে সংরক্ষিত সংকেত অথবা তথ্য গ্রহণকারী ‘রিসেপ্টরগুলো’ সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। গাঠনিক প্রকৃতি ও কার্যক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে কোষঝিল্লির এসব রিসেপ্টরকে আয়ন চ্যানেল সংযুক্ত রিসেপ্টর, এনজাইম সংযুক্ত রিসেপ্টর ও জি প্রোটিন কাপলড রিসেপ্টর (জিপিসিআর) বলে ভাগ করা হয়। আয়ন চ্যানেল সংযুক্ত রিসেপ্টরগুলো নিউরনকে সংকেত প্রদানে কার্যরত থাকে। এনজাইম সংযুক্ত রিসেপ্টরগুলো আন্তকোষীয় ফসফেট সংশ্লেষণে প্রভাবনের কাজ করে। সর্বশেষ, জি প্রোটিন কাপলড রিসেপ্টরগুলো অখণ্ড কোষঝিল্লির প্রোটিন, যা কিনা আন্তঝিল্লি হেলিক্স ধারণ করে। এ ধরনের রিসেপ্টর শুধু ইউক্যারিয়টিক বা সুকেন্দ্রিক কোষে পাওয়া যায়। এই রিসেপ্টরগুলো জি প্রোটিন সংযুক্ত বন্ধনকে সক্রিয় করে। এ ধরনের রিসেপ্টর সেভেনটিএম রিসেপ্টর, সর্পিল রিসেপ্টর বা জি প্রোটিন লিংকড রিসেপ্টর নামেও পরিচিত। এই রিসেপ্টরগুলো বিশেষ ধরনের প্রোটিন-গোষ্ঠীকে ধারণ করে, যা কোষের অণুগুলোর সংকেত বহন করে। বিভিন্ন রোগের সঙ্গে জি প্রোটিন কাপলড রিসেপ্টরগুলো সংযুক্ত। বর্তমানে ৪০ শতাংশ আধুনিক ওষুধ তৈরি করা হয় এই রিসেপ্টরগুলোর জন্য। বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধকের কার্যকারিতা নির্ভর করে এসব জি প্রোটিন কাপলড রিসেপ্টরের মতিগতির ওপর। জি প্রোটিন কাপলড রিসেপ্টরের কাজের ব্যাখ্যার জন্য ২০১২ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন দুই মার্কিন চিকিৎসাবিজ্ঞানী। জি প্রোটিন কাপলড রিসেপ্টরগুলো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আন্তকোষীয় বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদানের কাজের প্রকৃতি ব্যাখ্যার গবেষণায় সফলতা দেখিয়েছেন দুই গুরু-শিষ্য বিজ্ঞানী রবার্ট লেফকোভিৎজ ও ব্রায়ান কোবিলকা। ১৯৬৮ সালে লেফকোভিৎজ কোষের রিসেপ্টরগুলো সন্ধানের জন্য তেজস্ক্রিয়া ব্যবহার শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষায় হরমোনের সঙ্গে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ সংযুক্ত করেন। তিনি তেজস্ক্রিয়তার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি রিসেপ্টর খুঁজে পান। এগুলোর একটি হলো অ্যাড্রেনালিন হরমোন গ্রহণের বিটা অ্যাড্রেনার্জিক রিসেপ্টর। তিনি এই রিসেপ্টরের কাজের গতি-প্রকৃতি খুঁজে বের করেন। বিজ্ঞানী লেফকোভিৎজের গবেষণা দল গত শতকের আশির দশকে পোস্টডক্টরাল ফেলো হিসেবে ব্রায়ান কোবিলকা যোগদান করেন। মানব জিনোম থেকে বিটা অ্যাড্রেনার্জিক রিসেপ্টর আলদা করতে সক্ষম হন কোবিলকা। তিনি বিটা টু অ্যাড্রেনার্জিক রিসেপ্টরের আণবিক গঠন নির্ধারণ করতে সক্ষম হন। ২০১১ সালে কোবিলকা আর তাঁর গবেষক দল বিটা অ্যাড্রেনার্জিক রিসেপ্টরের ভিন্ন ধরনের ছবি তুলতে সফলতা লাভ করে। সেকেন্ডের কয়েক ভাগ কম সময়ে হরমোন গ্রহণের পর কোষে সংকেত পাঠানোর সময় এই চিত্র তুলতে সক্ষম হন তাঁরা। বিভিন্ন ওষুধের কার্যকারিতা বাড়াতে এই বিজ্ঞানীদের গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্ব বিবেচনা করেই নোবেল কর্তৃপক্ষ গুরু-শিষ্যের নাম ঘোষণা করে। রবার্ট লেফকোভিৎজ ১৯৪৩ সালে জন্ম নেওয়া পোলিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন লেফকোভিৎজ ব্রোনক্স হাইস্কুল অব সায়েন্স থেকে সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যা ও শল্য চিকিৎসায় ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি হাউয়ার্ড হিউজেস মেডিকেল ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। ব্রায়ান কোবিলকা ১৯৫৫ সালে জন্ম নেওয়া এই গবেষক মিনেসোটা দুলাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন ও জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করেন। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রবার্ট লেফকোভিৎজের তত্ত্বাবধানে পোস্টডক্টরাল ফেলো গবেষণা শুরু করেন। তিনি বর্তমানে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মলিউকুলার ও সেলুলার ফিজিওলজি বিভাগে অধ্যাপনায় নিযুক্ত। চিকিৎসা: স্টেম সেল গবেষণা প্রাথমিক কোষ স্টেম সেল গবেষণায় অনবদ্য অবদান রাখার স্বীকৃতির জন্য এ বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন যুক্তরাজ্যের গবেষক স্যার জন বার্ট্রান্ড গর্ডন ও জাপানের গবেষক শিনইয়া ইয়ামানাকা। গবেষকেরা পূর্ণবয়স্ক কোষ থেকে প্রাথমিক স্টেম সেল তৈরি করতে সক্ষম হন। এই প্রাথমিক স্টেম সেল বা কোষ থেকে পরবর্তী সময়ে যেকোনো ধরনের টিস্যু বা কলা তৈরি করা সম্ভব। ১৯৬২ সালে অধ্যাপক গর্ডন উভচর প্রাণী ব্যাঙের অন্ত্র বা পাকস্থলীর কোষ ব্যবহার করে ব্যাঙাচি ক্লোন করতে সক্ষম হন। সুস্থ-সবল ব্যাঙ হিসেবে বেড়ে ওঠে ব্যাঙাচি ক্লোনটি। বিজ্ঞানী গর্ডন ব্যাঙের অপরিণত ডিম্বক কোষের নিউক্লিয়াসকে প্রতিস্থাপন করতে অন্ত্র বা পাকস্থলীর পরিণত কোষ ব্যবহার করেন। পরিবর্তিত ডিম্বক কোষ থেকে ব্যাঙাচি জন্মগ্রহণ করে। অপর দিকে জাপানি বিজ্ঞানী ইয়ামানাকা গবেষণায় বের করেন, কীভাবে ইঁদুরের পরিণত কোষ পুনর্বিন্যস্ত হয়ে অপরিণত স্টেম সেলে পরিণত হয়। বিশেষ কয়েকটি জিনের উপস্থিতিতে পরিণত কোষ স্টেম সেলে পরিণত হয়। ত্বকের কোষের সঙ্গে বাড়তি চারটি জিন যোগ করে তৈরি করেন স্টেম সেল। পরে ওই স্টেম সেলগুলো থেকে তৈরি করা সম্ভব হয় দেহের যেকোনো অঙ্গের কোষ। স্টেম সেলগুলো যেকোনো পরিণত অঙ্গে রূপান্তরিত হতে সক্ষম। সাধারণ ধারণা ছিল, পরিণত কোষকে পুনরায় স্টেম সেলে রূপান্তরিত করা যায় না। কিন্তু জন গর্ডন ও শিনইয়া ইয়ামানাকা গবেষণায় প্রমাণ করেন, পরিণত কোষকে স্টেম সেলে রূপান্তর করা সম্ভব। জন বার্ট্রান্ড গর্ডন জন গর্ডন ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে প্রাণিবিদ্যা নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ব্যাঙের নিউক্লিয় ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করেন তিনি। শিনইয়া ইয়ামানাকা ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করা শিনইয়া ইয়ামানাকা কোবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এমডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি ওসাকা সিটি ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট স্কুল থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞান: দশা ছাড়াই দফারফা কোয়ান্টাম অপটিকস গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য চলতি বছর পদার্থবিদ্যায় যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ফ্রান্সের সার্জ হ্যারোশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড। কোয়ান্টাম কণা নিয়ে গবেষণার জন্য তাঁরা পুরস্কার পান। বস্তু ও শক্তির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাসমূহের জগৎ আমাদের সাধারণ ধারণার সাপেক্ষে এতটাই অদ্ভুত যে সেখানে কোনো কণার অবস্থা বা দশা জানতে হলে সেই কণার দশা পরিবর্তন করা ছাড়া উপায় থাকে না। এই জগৎ কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নামে পরিচিত। দশা পরিবর্তনকে পাশ কাটিয়ে এই কণা নিয়ন্ত্রণ করেই তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তা কাজে লাগানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন পদার্থবিজ্ঞানী সার্জ হ্যারোশ ও যুক্তরাস্ট্রের ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড। তাঁদের গবেষণা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিজ্ঞানী আহোশ প্যারিসের কলেজ দো ফ্রঁস এবং ইকোল নরমাল সুপেরিয়রের অধ্যাপক। ওয়াইনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজিতে অধ্যাপনা করেন। গ্রন্থনা: জাহিদ হোসাইন 
সূত্র: উইকিপিডিয়া ও নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ


Responses

0 Respones to "কোষের ভেতরে, কোয়ান্টাম কণাতে"

Return to top of page Copyright © 2011 | AL AMIN ET Converted into Blogger Template by SEO Templates